ভাবুন, আপনি গ্র্যাজুয়েশন প্রোগ্রাম কমপ্লিট করলেন। এখন আপনি প্রস্তুত, চাকরির বাজারে পা রাখতে!
আপনার কাছে এখন ডিগ্রি আছে, প্যাশন আছে আর প্রাণভর্তি আকাঙ্খা রয়েছে। কিন্তু এগুলো তো সবার কাছেই আছে!
আপনার কাছে কি এমন কিছু আছে, যেটা এই লক্ষ কোটি ডিগ্রিধারীদের মাঝে সবার কাছে নেই?
শুধুমাত্র অ্যাকাডেমিক কোয়ালিফিকেশনের কথাই বলছি না।
চাকরির বাজারে এখন, অ্যাকাডেমিক কোয়ালিফিকেশনের পাশাপাশি আরো বেশ কিছু স্কিল খোঁজা হচ্ছে চাকরি প্রার্থীদের মাঝে। এই স্কিলগুলোই আপনাকে চাকরির সুযোগ করে দিতে পারে, আপনার ক্যারিয়ারে দ্রুততা নিয়ে আসতে পারে আর আপনাকে স্যালারির সিঁড়ি বেড়ে উপরে উঠতে সাহায্য করতে পারে।
কিন্তু, কোন পাঁচটা স্কিল?
১. ক্রিটিক্যাল থিংকিং ও প্রব্লেম সল্ভিং
বর্তমানে গুগল আর ইউটিউবে সার্চ করলেই সব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায়, শেখার প্রয়োজন পড়ে না। কিন্তু, সেই তথ্য দিয়ে কিই-বা হবে যদি সেই তথ্যকে প্র্যাকটিক্যাল লাইফে কাজে লাগাতে না পারেন?
মূল ভ্যালুটা, এই ‘কিভাবে কাজে লাগাতে হয়’ – এই প্রশ্নের উত্তরেই লুকিয়ে আছে। আর এটাই শিখতে হয়। একটা গুগল সার্চে, সেটা জানা যায় না।
চাকরির বাজারেও এখন এমন গ্র্যাজুয়েটদের দরকার, যারা জটিল সমস্যার সহজ সমাধান বের করতে পারে, যারা একইসাথে অনেকগুলো পারস্পেকটিভ থেকে ভাবতে পারে এবং যারা পুরনো সমস্যাকে, নতুনভাবে সমাধান করতে জানে।
কিন্তু কেন ক্রিটিক্যাল থিংকিং আর প্রব্লেম সল্ভিং জানা উচিত?
দেখুন, প্রত্যেক ব্যবসাতেই উত্থান-পতনের দেখা মেলে। সেই উত্থান-পতন হতে পারে নতুন মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজি তৈরি করা কিংবা ক্রেতার অভিযোগ হ্যান্ডেল করা কিংবা অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান করা; একটা কোম্পানির যেকোনো জটিল সমস্যায় ঠান্ডা মাথায় ভেবে সিদ্ধান্ত নেয়া এবং সেই সমস্যাগুলোকে সমাধান করার মতো সামর্থ্য থাকবে; এমন ব্যক্তিকেই তো একটা কোম্পানির সুযোগ দেবে – তাই না?
SHRM এর একটা পরিসংখ্যান অনুসারে, ৩৭% চাকরিদাতার মতেই জটিল সমস্যার সমাধান করতে পারা; একজন চাকরিপ্রার্থীকে অন্যদের চেয়ে এগিয়ে রাখে।
২. ইফেক্টিভ কমিউনিকেশন
কমিউনিকেশন হচ্ছে, আপনার আর আপনার চাকরিদাতার মাঝে, একটা ব্রিজ।
এই ব্রিজ ছাড়া, যত ভালো প্রোফাইল থাকুক না কেন – সেটার কোনো ভ্যালু নেই।
লিংকডইনের একটা স্টাডি অনুসারে, ৫৭% চাকরিদাতার মতে – কমিউনিকেশন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্কিল একজন নতুন চাকরিপ্রার্থীর জন্য।
তবে মজার বিষয় হচ্ছে, কমিউনিকেশন কিন্তু শুধুমাত্র – ইন্টারভিউতে সুন্দর করে কথা বলতে পারাই নয়!
সময় দিয়ে শোনা ও বোঝার চেষ্টা করা, ইফেক্টিভলি সেই স্টেটমেন্টের জবাব দিতে পারা এবং ইফেক্টিভলি লিখতে জানা – এই সবকিছুই ইফেক্টিভ কমিউনিকেশনের অংশ।
একটা ইমেইল লিখতে যান কিংবা একটা আইডিয়া প্রপোজ করতে যান অথবা কলিগদের সাথে অ্যাঙ্গেজড হতে চান; আপনার চাকরিদাতা জানতে চাইছে; আপনি আসলেই আপনার চিন্তাধারাকে ঠিকভাবে শেয়ার করতে জানেন কী-না।
কমিউনিকেশনের ভুলে, অনেক কোম্পানিই মিলিয়ন ডলারের ক্ষতি বহন করে। এমনকি গ্রামারলির একটা পরিসংখ্যা অনুসারে, এই কমিউনিকেশনের ভুলেই শুধুমাত্র অ্যামেরিকান বিজনেসগুলোই প্রত্যেক বছরে প্রায় ১.২ ট্রিলিয়ন ডলার, প্রোডাক্টিভিটিতে ক্ষতিগ্রস্থ হয়।
কমিউনিকেশন স্কিলটাতে আরো গুরুত্ব দিন। অ্যাক্টিভ লিসেনিংয়ের প্র্যাকটিস করুন। যত বেশি প্র্যাকটিস করবেন, ততো দ্রুত জড়তা কেটে যাবে।
৩. খাপ খাইয়ে নেয়ার ক্ষমতা ও দ্রুত শেখার ক্ষমতা
চাকরির বাজার অনেক দ্রুত পরিবর্তন হয়। নতুন প্রযুক্তি আসে, গ্লোবাল ইভেন্ট আর ক্রেতার চাহিদায় পরিবর্তন আসে – আর এই কারণে চাকরিদাতারাও, চাকরিপ্রার্থীদের মাঝে পরিবর্তনকে দ্রুত খাপ খাইয়ে নেয়ার ক্ষমতা আর দ্রুত নতুন কিছু শেখার ক্ষমতা; খুঁজে থাকে।
McKinsey এর একটা রিপোর্ট অনুসারে, যেসব চাকরিপ্রার্থীদের মাঝে দ্রুত খাপ খাইয়ে নেয়ার ক্ষমতা দেখা যায়, তাদের চাকরি হওয়ার সম্ভাবনা ৩৩% বেড়ে যায়।
আপনি কি একসাথে অনেকগুলো টাস্ক ম্যানেজ করতে পারবেন? হুট করে কোনো সমস্যা চলে আসে, সেটার সমাধান করতে পারবেন? কাজের পরিবেশ পরিবর্তন হলে, আপনি কি সেটা হ্যান্ডেল করতে পারবেন?
এগুলোই আপনাকে দেখাতে হবে আপনার সিভি-রিজ্যুমি আর পোর্টফোলিওতে। এগুলোই আপনাকে এগিয়ে রাখবে আপনার প্রতিযোগীর চেয়ে।
৪. ডিজিটাল স্বাক্ষরতা ও প্রযুক্তিতে দক্ষতা
এই যুগে, প্রযুক্তিতে অজ্ঞতা – কোনভাবেই মেনে নেয়া যায় না।
ডিজিটাল স্বাক্ষরতা মানে – বিভিন্ন ডিজিটাল টুলস ও প্লাটফর্ম ব্যবহার করতে জানা ও বুঝতে পারা – আর এই দক্ষতা প্রায় প্রত্যেক চাকরির ফান্ডামেন্টাল একটা রিকোয়ারমেন্ট।
একটা রিপোর্ট মতে, ৮২% স্কিল বেইজড চাকরিতেই এই ডিজিটাল স্বাক্ষরতা এবং প্রযুক্তিতে দক্ষতা; খুবই গুরুত্বপূর্ণ রিকোয়ারমেন্ট হয়ে থাকে।
শুধু মাইক্রোসফট অফিস জানা আর সোশ্যাল মিডিয়া ব্রাউজ করতে জানাই; ডিজিটাল স্বাক্ষরতা নয়।
ডেটা কিভাবে কাজ করে, ডিজিটাল মার্কেটিং কিভাবে কাজ করে, কোন টুলসে কোন কাজ হয়ে থাকে, ফান্ডামেন্টাল কোডিং এবং ব্যাসিক সাইবার সিকিউরিটি সংক্রান্ত জ্ঞান থাকাও খুবই প্রয়োজন আর এগুলো ডিজিটাল স্বাক্ষরতারই অংশ।
আমি একটা ছোট্ট লিস্ট অনেক আগে করেছিলাম, আমার এক স্টুডেন্টকে শেখানোর উদ্দেশ্যে। সেই লিস্ট এখানে যুক্ত করে দিচ্ছি, যেগুলো যেকোনো স্কিল বেইজড কাজ শেখার শুরুতে ফান্ডামেন্টাল হিসেবে জানা উচিতঃ
- গুরুত্বপূর্ণ ডিজিটাল টুলস আর প্লাটফর্ম ব্যবহার করতে জানা
- পজিটিভলি অনলাইন প্রেসেন্স রাখতে শেখা
- জীবনে আপনার উদ্দেশ্য আর প্যাশন খুঁজে বের করা
- অনলাইন এথিকস, লিগ্যালিটি ও রেগুলেশন্স জানা
- বাজেটিং, সেইভিং আর অর্থনৈতিক স্বাক্ষরতা
- নেটওয়ার্কিং ও সাপোর্ট সিস্টেম সম্পর্কে শেখা
- গ্রোথ মাইন্ডসেট ও সফট স্কিল সম্পর্কে জানা
- কমিউনিকেশন ও নেগোসিয়েশন করতে জানা
৫. টিমওয়ার্ক ও কোলাবোরেশন
টিমওয়ার্ক করতে জানা খুবই প্রয়োজনীয় একটা স্কিল।
একটা পরিসংখ্যা অনুসারে, ৭৫% কোম্পানিতে টিমওয়ার্ক করতে জানেন কী-না সেটার উপর ভিত্তি করে চাকরিপ্রার্থী বাছাই করা হয়। একটা স্টার্টআপ হোক কিংবা বিশাল বড় কোম্পানি; টিমওয়ার্ক ছাড়া চাকরিতে টিকে থাকা খুবই কষ্টকর হয়ে যাবে।
গ্রুপে কাজ করতে জানা, ভিন্ন ভিন্ন পারস্পেকটিভকে সমান চোখে দেখা ও সম্মান করা এবং কোলাবোরেশনের মাধ্যমে সমস্যার সমাধান খুঁজে বের করা – এগুলো খুবই অল্প কিছু চাকরিপ্রার্থীর মাঝেই দেখা যায়।
শুধু চাকরিতে যোগদানের জন্যেই নয়, বরঞ্চ এই স্কিলগুলো জানা থাকলে – আপনার স্যালারির পরিমাণও দ্রুত বাড়বে এবং নতুন কোনো ইনকামের সুযোগও বের হয়ে আসবে।
NACE এর একটা স্টাডি মতে, যাদের মাঝে এই ৫টা স্কিল দেখা যায়; তাদের সেই চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনা ২৫% বেড়ে যায়!
তাহলে, এই হচ্ছে সেই ৫টা স্কিল যেগুলো আপনাকে এই প্রতিযোগীতার চাকরির বাজারে, অনেকটা এগিয়ে রাখবে।
তবে মূল কথা হচ্ছে, শুধুমাত্র চাকরির জন্যেই নয় – এই স্কিলগুলো সারাজীবনের জন্য।
নতুন কোনো পদে পা রাখা কিংবা কর্পোরেট লাইফে শক্তিশালী নেটওয়ার্ক তৈরি করা অথবা কোনো একদিন নিজের সফল ব্যবসা দাঁড় করানো – প্রত্যেক ধাপেই আপনাকে এই ৫টা স্কিল সাহায্য করবে। এই স্কিলগুলো, আপনার ভবিষ্যতের গ্রোথের প্রথম চাকা হতে পারে।
কিন্তু মনে রাখবেন, শুধু সিভি বা রিজ্যুমিতে যুক্ত করার জন্যেই শেখা নয় – কিভাবে সেই স্কিলগুলোকে ব্যবহার করতে হবে এবং সেই স্কিলগুলো ব্যবহার করে প্র্যাকটিক্যাল লাইফে গ্রোথ নিয়ে আসতে হবে; সেটা জানা জরুরী।
তাহলে আজ থেকেই শেখা শুরু করুন।
মনে করুন, আপনার ক্যারিয়ার হচ্ছে একটা শূন্য ক্যানভাস। আপনার ডিগ্রি সেই ক্যানভাসের রঙগুলো।
কিন্তু এই ৫টা স্কিল – আপনার ক্যানভাসের ব্রাশ।
সঠিক ব্রাশ দিয়ে সঠিক ভাবে আঁকতে পারলে, মাস্টারপিস আপনার পক্ষেও তৈরি করা সম্ভব।
প্রশ্ন হচ্ছে, আপনি কী আঁকতে যাচ্ছেন?
চাকরির বাজারে টিকে থাকতে এই ৫টি স্কিল নিয়ে এই লেখাটি খুব ভালোভাবে ব্যাখ্যা করেছে
ধন্যবাদ
Pleasure is mine